ছোটবেলায় অ্যাথলেটিক্সে তীব্র নেশা ছিল। তখন বক্সিংয়ে আসার কথা ভাবেননি। মাঝে মাঝে মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেত, বক্সিংয়ে কেন মেয়েরা এত কম আসে? বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলেন নিখাত জারিন। মেয়েরা নাকি শারীরিক দিক দিয়ে বক্সিংয়ের উপযুক্ত নয়। বাবার কথাটা নাড়া দিয়েছিন নিখাতকে। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, অ্যাথলেটিক্স ছেড়ে বক্সিং শুরু করবেন। যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। অ্যাথলেটিক্স ছেড়ে বক্সিংয়ে আসা সেই নিখাত জারিনের হাত ধরে অলিম্পিকে বক্সিংয়ে প্রথম সোনা জয়ের স্বপ্ন দেখছে ভারত।
বক্সিংয়ে এখনও পর্যন্ত মাত্র দুটি পদক জিতেছে ভারত। ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জিতে ইতিহাস তৈরি করেছিলেন মেরি কম। সেটাই ছিল মহিলাদের বক্সিংয়ে প্রথম পদক। ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে দেশকে ব্রোঞ্জ এনে দিয়েছিলেন লভলিনা বরগোহাইন। প্যারিস অলিম্পিকেও মহিলাদের বক্সিংয়ে পদক জয়ের সুযোগ আছে ভারতের। লভলিনার সুযোগ তো রয়েছেই, পদক আসতে পারে নিখাত জারিনের হাত ধরে। অথচ, এই নিখাত জারিনকে একসময় বক্সিংয়ে দিতে চাননি তাঁর মা। কারণ শুনলে অবাক হয়ে যাবেন, মেয়ের জন্য নাকি বিয়ের পাত্র পাওয়া যাবে না।
১৯৯৬ সালে অধুনা অন্ধ্রপ্রদেশের নিজামাবাদে জন্মগ্রহন করেন নিখাত জারিন। ছোটবেলায় অ্যাথলেটিক্সের প্রতি দারুণ অনুরাগী ছিলেন নিখাত জারিন। ১০০ মিটার ও ২০০ মিটার তাঁর প্রিয় ইভেন্ট ছিল। স্কুল ও জেলা পর্যায়ে পদকও জিতেছিলেন। হঠাৎ করে একদিন বাবা মহম্মদ জামিল আমেদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, বক্সিংয়ে মেয়েদের খুব বেশি দেখা যায় না কেন? নিখাতের বাবার উত্তর ছিল, শারিরীকভাবে মেয়েরা ততটা শক্তিশালী নয়, তাই বক্সিংয়ে আসতে চায় না। বাবার কথা শুনে জেদ চেপে গিয়েছিল নিখাত জারিনের। অ্যাথলেটিক্স ছেড়ে বক্সিংয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
এদিকে, মেয়ের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়েছিলেন নিখাতের মা পরভীন সুলতানা। মেয়ে কিনা বক্সিং খেলবে! বক্সিংয়ে পুরুষদের সঙ্গেও তো প্র্যাকটিস করতে হয়। প্রথমেই তিনি আপত্তি জানিয়েছিলেন। মায়ের আপত্তি না শুনেই বক্সিং প্র্যাকটিস শুরু করেন নিখাত জারিন। একদিন অনুশীলন সেরে যখন বাড়ি ফিরেছিলেন নিখাত, চোখের কোণে আঘাত, নাক দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। আতঙ্কে কেঁদে ফেলেছিলেন নিখাতের মা। সরাসরি নিখাতের বাবার কাছে প্রশ্নটা করেই ফেলেছিলেন, ‘এইভাবে চোখ–মুখ ফেটে মুখ বিকৃত হয়ে গেলে মেয়ের বিয়ে দেব কীভাবে?’ নিখাতকে বক্সিং থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য বারংবার অনুরোধ করেছিলেন বাবার কাছে। নিখাত অবশ্য দমবার পাত্রী ছিলেন না। মাকে সরাসরি উত্তরটা দিয়েই বসেন, ‘আম্মি, টেনশন কোরো না। নাম হয়ে গেলে দেখবে বিয়ের জন্য পাত্রদের লাইন পড়ে যাবে।’ নিখাতের সেই কথাই এখন সত্যি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিখাতের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে বাবা জামিল আমেদ তাঁকে ২০০৯ সালে বিশাখাপত্তনমের সাইতে ভর্তি করে দেন। দ্রোনাচার্য কোচ আইভি রাওয়ের তত্ত্বাবধানে অল্পদিনের মধ্যেই বক্সিংয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন নিখাত জারিন। ২০১০ সালে জাতীয় ইন্ডোর প্রতিযোগিতায় সেরা বক্সারের পুরস্কার পান। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি নিখাতকে।
২০১১ সালে মেয়েদের জুনিয়র ও ইয়ুথ বিশ্ব বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জেতেন। ২০১৪–তে বিশ্ব ইয়ুথ বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে রুপো। ২০১৫–তে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। এরপর একের পর এক সাফল্য। ২০১৯ সালে ব্যাঙ্ককে ফ্লাইওয়েট বিভাগে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ, ২০২২ সালে ইস্তানবুলে ফ্লাইওয়েট ও গত বছর দিল্লিতে লাইট ফ্লাইওয়েটের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জয়। ২০২২ সালে হাংঝৌ এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ ও কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জিতেছিলেন। গতবছর দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে দ্বিতীয় সোনা। এবার অলিম্পিকে পদক জিতলে বৃত্ত সম্পূর্ণ হবে নিখাত জারিনের।
জীবনের প্রথম অলিম্পিকে নেমে পদক জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী নিখাত জারিন নিজেও। তিনি বলেন, ‘সব প্রতিযোগিতাতে সেরাটা দিয়ে পদক পেয়েছি। অলিম্পিকেও সেরাটা দিতে পারলে পদক জিততে কোনও সমস্যা হবে না। সকলে আমার মধ্যে পদক জয়ের সম্ভাবনা দেখছে। এটা প্রত্যাশার চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশবাসীর এই প্রত্যাশার চাপ আমার কাছে আশীর্বাদ হবে।’ অনেকেই তাঁর সঙ্গে মেরি কমের তুলনা শুরু করেছেন। নিখাত অবশ্য মেরি কমের সঙ্গে তুলনা করতে চাননা। তাঁর কাছে মেরি কম কিংবদন্তি। নিখাতের কথায়, ‘মেরি কম নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ৬ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। ওর কৃতিত্ব কেউ স্পর্শ করতে পারবে না।’ তবে অলিম্পিকের সাফল্যের ব্যাপারে মেরি কমকে ছাপিয়ে যেতে যান নিখাত জারিন।
আরও পড়ুনঃ ডার্বি জয়ের পর হোঁচট, টানা ৩ ম্যাচ পর ড্র, কাস্টমসের কাছে আটকে গেল ইস্টবেঙ্গল