ট্রেন্ডিং

Chess

‌মরণোত্তর গ্র্যান্ডমাস্টার মীর সুলতান খান, পাকিস্তানের প্রথম গ্র‌্যান্ডমাস্টার

মরণোত্তর গ্র‌্যান্ডমাস্টার!‌ তাও আবার মৃত্যর ৫৮ বছর পর!‌ হ্যাঁ, অবাক হলেও এটাই সত্যি। নিজে দেখে যেতে না পারলেও দাবার ইতিহাসে থেকে যাবে মীর সুলতান খানের নাম, পাকিস্তানের প্রথম গ্র‌্যান্ডমাস্টার হিসেবে।

মরণোত্তর গ্র‌্যান্ডমাস্টার

স্পোর্টস টাইম ওয়েব ডেস্ক

শেষ আপডেট: জুন ১৫, ২০২৪
Share on:

মরণোত্তর গ্র‌্যান্ডমাস্টার!‌ তাও আবার মৃত্যর ৫৮ বছর পর!‌ হ্যাঁ, অবাক হলেও এটাই সত্যি। নিজে দেখে যেতে না পারলেও দাবার ইতিহাসে থেকে যাবে মীর সুলতান খানের নাম, পাকিস্তানের প্রথম গ্র‌্যান্ডমাস্টার হিসেবে। ২০২৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ইসলামাবাদে পাকিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারুল হক কাকারের হাতে সুলতান খানের মরণোত্তর গ্র‌্যান্ডমাস্টারের শংসাপত্র তপলে দেন বিশ্ব দাবা সংস্থা ফিডে–র প্রেসিডেন্ট আরকাদে দভরকোভিচ।

১৯৬৬ সালে মারা যান সুলতান খান। ৫৮ বছর পর তাঁকে মরণোত্তর গ্র্যান্ডমাস্টারের খেতাব দিয়েছে ফিডে। আর তাতেই পাকিস্তান পেয়ে গেল প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার। ফিডের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘মীর সুলতান খান পাঞ্জাবের দাবাড়ু এবং পাকিস্তানের নাগরিক। তাঁর সময়ে তাঁকে এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দাবাড়ু বিবেচনা করা হত। পাঁচ বছরেরও কম সময়ের আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে তিনি তিনবার ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন। দাবার তত্ত্বজ্ঞান এবং এই খেলার বইপত্র প্রায় না পড়েই বিশ্বের সেরা কয়েকজন খেলোয়াড়কে হারিয়েছিলেন মীর সুলতান খান। তিনি পাকিস্তানের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার।’

সুলতান যখন দাবার ৬৪ ঘরে রাজত্ব কায়েম করেছিলেন, সমগ্র উপমহাদেশ তখন ব্রিটিশ শাসনের অধীন। সেই সময় সর্বকালের অন্যতম সেরা পোলিশ কিংবদন্তি আকিবা রুবিনস্টেইনকে হারিয়েছিলেন সুলতান খান। সেই রুবিনস্টেইন ১৯৫০ সালে জীবদ্দশাতেই গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব পেয়ে যান। সেই বছরই ফিডে গ্র‌্যান্ডমাস্টার খেতাব চালু করেছিল। কিন্তু সুলতানকে অপেক্ষা করতে হয়েছে মৃত্যুর পরও। ‌‘প্রতীক্ষাতে প্রতীক্ষাতে/ সূর্য ডোবে রক্তপাতে।’ পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতার লাইনটা সুলতান খানের ক্ষেত্রে সত্যিই প্রযোজ্য।

৫৮ বছরের প্রতীক্ষায় বুকের ভেতর রক্তপাত না হওয়াটাই সুলতান খানের অস্বাভাবিক। তবে সুলতান যে খেতাবটা পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন, সে কথাও জোর দিয়ে বলা যায় না। সে সময় অনেক বাঙালির মতোই ইউরোপে কনকনে ঠান্ডা আবহাওয়া তাঁর সহ্য হয়নি। কলকাতার মেটিয়াবুরুজ থেকে উঠে আসা খালি পায়ের ফুটবলার মহম্মদ সেলিমকে নিশ্চয়ই মনে আছে? উপমহাদেশের প্রথম ফুটবলার হিসেবে যিনি ইউরোপীয়ান ক্লাব সেল্টিকে খেলেছিলেন। স্কটল্যান্ডের আবহাওয়া সহ্য করতে না পরে এবং দেশের টানে কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন সেলিম। সুলতান খানের সেলিমের মতো অবস্থা। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে যেন মুক্তি পেয়েছিলেন।

সুলতানের জন্ম বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের খুশাব শহরের মিঠা তিওয়ানা অঞ্চলে। তাঁর পূর্বপুরুষেরা পীর ও জমিদারদের মুসলিম আওয়ান গোত্রের। বাবা মিয়া নিজাম দীনের কাছে দাবার চাল শিখেছিলেন সুলতান। কৈশোরেই তাঁর প্রতিভা ফুটে উঠেছিল। প্রায় প্রতিদিনই জমিদার ও দাবাপ্রেমীদের সঙ্গে খেলার জন্য সারাগোদা শহরে যেতেন। এরপর দ্রুতই সারাগোদার পাশের অঞ্চল কালরার জমিদার ও মেজর জেনারেল স্যার উমর হায়াত খান তিওয়ানার নজরে পড়ে যান সুলতান খান। এই স্যার উমর তিওয়ানা ব্রিটিশ আনুগত্য মেনে গোটা পাঞ্জাবের প্রভাবশালী জমিদার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। শিল্প ও খেলাধুলার পৃষ্ঠপোষক উমর হায়াত সুলতানকে দেখে হাতে চাঁদ পেয়েছিলেন। সুলতানকে তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন, বৃত্তি ও থাকার ব্যবস্থার বিনিময়ে জমিরদারিতে একটা দাবার দল গঠন করে দেওয়ার।

উমর হায়াতের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে সুলতান কালরায় চলে যান। ১৯২৮ সালে অল ইন্ডিয়া চেস চ্যাম্পিয়নশিপ খেতাব জেতেন। পরের বছর সুলতানকে নিয়ে উমর হায়াত ইংল্যান্ড চলে যান। সেখানে কুলীন ইমপেরিয়াল চেস ক্লাবের সদস্য হন সুলতান। সে সময় দাবা খুব ব্যয়বহুল এবং অভিজাতদের খেলা ছিল। দাবা ক্লাবের সদস্য হতে এবং টুর্নামেন্টে অংশ নিতে প্রচুর টাকা ফি দিতে হত। ১৯২৯ সালে ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েছিলেন সুলতান খান। চ্যাথাম হাউস স্কুলে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন ১২ দাবাড়ু। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন মাস্টার দাবাড়ুও ছিলেন। সবাইকে পেছনে ফেলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন সুলতান খান, যাকে অন্যরা কেউ চিনতেন না।

সেই সময় ইউরোপ ছিল দাবা বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু। ইউরোপ ও উপমহাদেশের দাবা খেলার নিয়মে তখন অনেক পার্থক্য ছিল। উপমহাদেশের নিয়মে প্রথম চালে বোড়ে দুই ঘর এগোতে পারবে না। ক্যাসলিংয়ের নিয়মও আলাদা ছিল। আর রাজা অন্তত একটা চালে মন্ত্রীর মতো এগোতে পারবে। উমর হায়াতের সঙ্গে ইউরোপে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সুলতান সেখানকার দাবা খেলার নিয়ম সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। বাবার কাছে শেখা ভারতীয় খেলার ধরনই ছিল তাঁর সম্বল।

ইউরোপীয়দের মুখোমুখি হওয়ার আগে সুলতানকে তাঁদের নিয়মের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছিল। ব্যাপারটা যথেষ্ট কঠিন ছিল। এছাড়া দাবা সম্পর্কে সুলতান খানের কোনও পুঁথিগত বিদ্যা ছিল না। খেলা কীভাবে শুরু করতে হবে, সেসব তত্ত্বজ্ঞান সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতেন না। এই ব্যাপারে ইউরোপীয় দাবাড়ুরা অনেক এগিয়ে ছিল। কিন্তু সুলতানের প্রতিভাকে আটকে রাখা যায়নি। অর্ধেকের বেশি ম্যাচ জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। হেরেছিলেন মাত্র একটা ম্যাচে।

এর পর ১৯৩২ ও ১৯৩৩ সালে আরও দু’‌বার ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিলেন সুলতান খান। সে সময় পৃথিবীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির বিচারে ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপের মর্যাদা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের মতো ছিল। প্রথমবার এই চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে বাঘা বাঘা দাবাড়ুর নজরে পড়ে গিয়েছিলেন সুলতান। পরের চার বছর তাঁকে নিয়ে দাবার বোর্ডে তোলপাড় চলেছিল।  

প্রথমবার ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে ১৯৩০ সালের মে মাসে অল্প কিছুদিনের জন্য জন্মভূমিতে ফিরে এসেছিলেন সুলতান। আবার ইউরোপে ফেরার পর বিভিন্ন দাবা টুর্নামেন্টে খেলার প্রস্তাব পেতে থাকেন। ১৯৩০ সালের জুলাইয়ে ইংল্যান্ডের স্কারবরোয় টুর্নামেন্টে চতুর্থ হন, যেখানে ইউরোপের তৎকালীন শীর্ষ পাঁচ দাবাড়ুও খেলেছিলেন। এরপর হামবুর্গে তৃতীয় দাবা অলিম্পিয়াডে ইংল্যান্ড তাঁকে নিজেদের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে খেলায়। ৯ টি গেম জিতেছিলেন সুলতান, ৪ টি হার ও ৪ টি ড্র। হামবুর্গের পর বেলজিয়ামের লিয়েজে আমন্ত্রণী টুর্নামেন্টে বিশ্বখ্যাত দাবাড়ু সাভিয়েল্লি টারটাকোয়ারের পর দ্বিতীয় হন। কয়েক মাস সেই টারটাকোয়ারকেই হারিয়ে দেন ১২ গেমের ম্যাচে।

সুলতানের জীবনে মাহেন্দ্রক্ষণ ছিল ১৯৩০ সালের শেষ থেকে ১৯৩১ সালের শুরুর দিক পর্যন্ত। হাস্টিংসে আয়োজিত এক এলিট টুর্নামেন্টে দাবার দুই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ম্যাক্স ইউয়ি ও হোসে রাউল কাপাব্লাঙ্কার পর তৃতীয় হয়েছিলেন সুলতান। কাপাব্লাঙ্কা ছিলেন দাবার সর্বকালের সেরাদের মধ্যে অন্যতম। সেই টুর্নামেন্টে কাপাব্লাঙ্কাকে হারিয়ে সুলতান দাবা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ওই ম্যাচে সুলতানের খেলার স্টাইল দারুণ আলোচিত হয়েছিল। কাপাব্লাঙ্কাকে বুঝতে না দিয়ে ধীরে ধীরে তাঁকে ম্যাচ থেকে ছিটকে দিয়েছিলেন সুলতান।

১৯৩১ সালে প্রাগে আয়োজিত চেস অলিম্পিয়াডেও ইংল্যান্ডকে নেতৃত্ব দিয়ে দুর্দান্ত সাফল্য পেয়েছিলেন সুলতান। ৮ জয়, ৭ ড্র ও ২ হার। হেরেছিলেন সে সময় বিশ্বের সেরা ১০ দাবাড়ুদের তালিকায় থাকা সলমন ফ্লোর ও আকিবা রুবেনস্টেইনের কাছে। ড্র করেছিলেন তৎকালীন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আলেক্সান্দার আলেখিনের সঙ্গে। ১৯৩২ সালে খেলেছেন কেমব্রিজ প্রিমিয়ার লিগেও। সেখানে ইংল্যান্ডের সেরা দাবাড়ুদের হারিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে ছিলেন কোনেল হিউ ও’ডনেল আলেকজান্ডার। ১৯৩৩ ছিল সুলতানের দাবার বোর্ডে শেষ প্রতিযোগিতামূলক বছর। সেবারও ইংল্যান্ডের শীর্ষ খেলোয়াড় হিসেবে দাবা অলিম্পিয়াডে অংশ নেন, জেতেন ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপ।

১৯৩৩ সালের ডিসেম্বরে ইংল্যান্ডে রাউন্ডটেবিল কনফারেন্স শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে উমর হায়াতের ইংল্যান্ড সফরও শেষ হয়। উমর হায়াতের সঙ্গে সুলতানকেও ইউরোপ ছেড়ে দেশে ফিরতে হয়। এরপর আর কখনোই তিনি ইউরোপে যেতে পারেননি, মুখোমুখি হতে পারেননি বিশ্বসেরা সব দাবাড়ুর। সুলতানের কিন্তু তাতে মনে কোনো কষ্ট ছিল না। ইংল্যান্ড ছাড়তে পেরে তিনি খুশিই হয়েছিলেন। সেখানকার ঠান্ডা ও বৃষ্টির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি। ইংল্যান্ড ছেড়ে সুলতানের মনে হয়েছিল, তিনি যেন জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। দেশে ফেরার পর ১৯৩৫ সালে একবারই প্রতিযোগিতামূলক দাবায় অংশ নিয়েছিলেন সুলতান। ভিকে খাদিলকারের বিরুদ্ধে সেই লড়াইয়ে ৯ টি জয় ও ১ টি ড্র। তখনও বোঝা গিয়েছিল উপমহাদেশে অন্তত সুলতানের কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। এরপর সুলতান আর কোনও প্রতিযোগিতামূলক দাবায় অংশ নেননি।

কেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ খেতাবের জন্য লড়াই করেননি সুলতান? একসময় তিনি বলেছিলেন, ‌সে সময় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ খেতাবের জন্য লড়াইয়ে অংশ নিতে অন্তত ২০০০ পাউন্ড ফি দিতে হত। এই বিপুল পরিমান অর্থ জোগাড় করা তাঁর পক্ষে কোনও ভাবেই সম্ভব ছিল না। উমর হায়াত তাঁর খরচ নির্বাহ করতেন, বিভিন্ন টুর্নামেন্টে পাঠাতেন। এটা সুলতানের কাছে ছিল শাঁখের করাত। কারণ, একজন ব্যক্তির ইচ্ছা–অনিচ্ছার ওপর তাঁর দাবা কেরিয়ার নির্ভর করেছে। এ জন্যই তিনি ইউরোপে আর খেলতে পারেননি।

ইউরোপ থেকে ফেরার পর নিজ বাসভূমে চাষবাসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সুলতান। তাঁর ছেলে ও নাতিপুতিরাও দাবা খেলেন। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্ট থেকে বিরত থাকেন। সুলতান যখন দাবা খেলেছেন, তখন কোনও  অফিশিয়াল র‌্যাঙ্কিং সিস্টেম ছিল না। তবে দাবার বিশ্বস্ত ওয়েবসাইট চেস মেট্রিকস, যারা গত ২০০ বছরের দাবাড়ুদের র‌্যাঙ্কিং নির্ধারণ করেছে, সেই ওয়েবসাইট অনুসারে দাবা কেরিয়ারের শেষ দু’‌বছরে সুলতান বিশ্বের সেরা ষষ্ঠ অথবা সপ্তম খেলোয়াড় ছিলেন। ইউরোপীয়দের মতো খেলা কীভাবে শুরু করতে হবে, সুলতান তা না জানলেও রুবিনস্টেইনের মতে, তিনি ‘মাঝে এবং শেষের খেলার মাস্টার।’ তবে সুলতান তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে সেরা স্বীকৃতিটা পেয়েছেন কাপাব্লাঙ্কার কাছ থেকে। দাবায় সর্বকালের সেরা প্রতিভা হিসেবে স্বীকৃত কাপাব্লাঙ্কা নিজের এক লেখায় সুলতান সম্পর্কে একটা মাত্রই শব্দ ব্যবহার করেছিলেন, ‘জিনিয়াস’।


আরও পড়ুনঃ

অন্যান্য খবর

We are a sports news media company which covers sports across the world. In 2021, "Sports Time" Magazine started its humble journey and quickly won the hearts of sports lover people. After the success of the magazine, we decided to venture into digital pl

Copyright © 2025 Sports Time News Portal . All Rights Reserved. Designed by Avquora