বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স মঞ্চে চমকে দিয়েও মাত্র সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময়ের জন্য প্যারিস অলিম্পিকের টিকিট পাননি। হতাশায় চোখে জল। তাহলে কি ছোট থেকে দেখে আসা অলিম্পিকের স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে? না স্বপ্ন শেষ হয়নি জ্যোতি ইয়ারাজির। ইতিহাস গড়েই প্যারিসে যাচ্ছেন এই ভারতীয় মহিলা হার্ডলার।
মে মাসে ফিনল্যান্ডের জাভাস্কিলায় বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স কন্টিনেন্টাল ট্যুরে (চ্যালেঞ্জার লেভেল) মহিলাদের ১০০ মিটার হার্ডলসে সময় নিয়েছিলেন ১২.৭৮ সেকেন্ড। অলিম্পিকে সরাসরি যোগ্যতা অর্জন করতে গেলে ১২.৭৭ সেকেন্ড সময় করতে হত। জ্যোতির দুর্ভাগ্য, মাত্র সেকেন্ডের দশমাংশ সময়ের জন্য প্যারিস অলিম্পিকের ছাড়পত্র পাননি। তবুও অলিম্পিকের ছাড়পত্র পেয়ে গেছেন জ্যোতি ইয়ারাজি। ১০০ মিটারে প্রথম ভারতীয় মহিলা হার্ডলার হিসেবে অলিম্পিকের ছাড়পত্র পেয়ে ইতিহাস গড়েছেন অন্ধ্রপ্রদেশের এই অ্যাথলিট।
হয়তো শুনতে একটু অবাক লাগছে। অলিম্পিকের যোগ্যতামান স্পর্শ না করেও কীভাবে অলিম্পিকে যাচ্ছেন জ্যোতি। ফিনল্যান্ডের বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স কন্টিনেন্টাল ট্যুরের সময় জ্যোতি অ্যাথলেটিক্সের ‘রোড টু প্যারিস’–এর তালিকায় ২৬ নম্বরে ছিলেন। প্যারিস অলিম্পিকে মহিলাদের ১০০ মিটার হার্ডলসে ৪০ জন দৌড়বিদ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এই ৪০ জনের মধ্যে ২৫ জন সরাসরি যোগ্যতা অর্জন করেছেন। বাকি ১৫ জন সুযোগ পেয়েছেন বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ের ভিত্তিতে।
৩০ জুন ছিল বাছাইয়ের শেষ দিন। র্যাঙ্কিংয়ে অনেকটাই নেমে গিয়েছিলেন জ্যোতি। যেদিন বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স সংস্থা ‘রোড টু প্যারিস’–এর তালিকা প্রকাশ করেছিল, জ্যোতির র্যাঙ্কিং ছিল ৩৪। তাতেও প্যারিসের টিকিট পেতে সমস্যা হয়নি। ফিনল্যান্ডের বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স কন্টিনেন্টাল ট্যুরের (চ্যালেঞ্জার লেভেল) পরেও পাঁচটি প্রতিযোগিতায় জ্যোতির সামনে সুযোগ ছিল অলিম্পিকের যোগ্যতামান স্পর্শ করার। কাজে লাগাতে পারেননি।
সরাসরি অলিম্পিকের কোটা না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তবুও স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি। জ্যোতির কথায়, ‘প্রত্যেক ক্রীড়াবিদ অলিম্পিকে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। আমারও স্বপ্ন ছিল। সরাসরি সুযোগ না পেয়ে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। তবুও স্বপ্ন দেখা ছাড়িনি। কারণ, র্যাঙ্কিংয়ের ভিত্তিতে একটা সুযোগ ছিল। জানতাম, ৩০ জুনের মধ্যে ৪০–এর মধ্যে থাকতে পারলেই প্যারিসের টিকিট পাব। শেষ পর্যন্ত স্বপ্ন সত্যি হল। এবার অলিম্পিকে সেরাটা দেওয়ার পালা।’ আশা ছাড়েননি বলেই ভুবনেশ্বরের রিলায়েন্স ফাউন্ডেশন হাই পারফরম্যান্স সেন্টারে নিজেকে অলিম্পিকের প্রস্তুতিতে মগ্ন রেখেছিলেন।
অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমে জন্ম জ্যোতি ইয়ারাজির। বাবা সূর্যনারায়ণ ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রহরী, মা কুমারী শহরের একটা হাসপাতালে ক্লিনার হিসাবে আংশিক সময় কাজ করেন। বিশাখাপত্তনমের পোর্ট হাইস্কুল কৃষ্ণায় পড়ার সময় শারীর শিক্ষার শিক্ষক জ্যোতিকে ১০০ মিটার হার্ডলস করার পরামর্শ দেন। ২০১৫ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের এক আন্তঃজেলা মিটে সোনা জিতে প্রথম আলোতে আসেন। পরের বছর তাঁকে হায়দরাবাদের সাইতে নিয়ে যান অলিম্পিয়ান এবং দ্রোণাচার্য পুরস্কারপ্রাপ্ত কোচ এন রমেশ।
এরপর ধারাবাহিকভাবে জুনিয়র এবং সিনিয়র জাতীয় মিটে পদক জিততে থাকেন জ্যোতি। হায়দরাবাদের সাইতে ২ বছর থাকার পর গুন্টুরের সেন্টার অফ এক্সেলেন্সে সুযোগ পান। এই সেন্টার হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে ২০১৯ সালে ভুবনেশ্বরের ওড়িশা রিলায়েন্স অ্যাথলেটিক্স হাই পারফরম্যান্স সেন্টারে চলে আসেন। সেখানে তিনি ব্রিটিশ কোচ জেমস হিলিয়ারের কাছে নিজেকে পরিমার্জিত করেন। খুব কম সময়ের মধ্যেই জেমস হিলিয়ারের অধীনে জ্যোতির অগ্রগতি ঘটে। ২০২০ সালে কর্ণাটকের মুদাবিদ্রিতে সর্বভারতীয় আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় অ্যাথলেটিক্স মিটে সোনা জেতেন। সময় নিয়েছিলেন ১৩.০৩ সেকেন্ড।
২০২০–২০২১ সময়টা জ্যোতির কাছে ছিল খুবই কঠিন। একদিকে করোনার জন্য প্রতিযোগিতা বন্ধ, অন্যদিকে পিঠের চোট। পিঠের চোটের কারণে কয়েক মাস মাঠের বাইরে থাকার পর পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারম করে। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে অ্যাথলেটিক্সই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। জ্যোতির আত্মবিশ্বাস ফেরানোর দায়িত্ব তুলে নেন কোচ জেমস হিলিয়ার। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি জ্যোতিকে। যখন তিনি ট্র্যাকে ফিরে আসেন, নিজেকে সম্পূর্ণ বদলে ফেলেছিলেন। হিলিয়ার না থাকলে হয়তো ট্র্যাক থেকে অনেকটাই দূরে চলে যেতেন জ্যোতি, অলিম্পিকের স্বপ্নও পূরণ হত না।