ট্রেন্ডিং

Shooting : Sandeep Singh

‌সিয়াচেনের মাইনাস ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ট্রিগার হাতে দেশ পাহারা দেওয়ার ফাঁকে অলিম্পিকের স্বপ্ন দেখতেন সন্দীপ

ডোপিংয়ের অভিযোগে একসময় শুটিং ছেড়ে দিতে হয়েছিল। সেখান থেকে আবার ট্র‌্যাকে ফেরা। ‌সিয়াচেনের মাইনাস ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ট্রিগার হাতে দেশ পাহারা দেওয়ার ফাঁকে অলিম্পিকের স্বপ্ন দেখতেন। কঠিন দিনগুলিকে পেছনে ফেলে এবার প্যারিস থেকে পদক নিয়ে আসার স্বপ্ন দেখছেন সন্দীপ সিং।

প্যারিস থেকে পদক নিয়ে আসার স্বপ্ন দেখছেন সন্দীপ সিং

নাসরীন সুলতানা

শেষ আপডেট: জুলাই ০১, ২০২৪
Share on:

৮ বছর আগেকার কথা। উত্তরপ্রদেশের ফতেগড়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ট্রেনিং গ্রাউন্ডে হাতে তুলে নিয়েছিলেন একটা ইনসাস রাইফেল। প্রথম শুটেই নজর কেড়েছিলেন। অনুশীলনের জন্য ৩০০ মিটার দূরে রাখা লক্ষ্যবস্তুতে ২ মিলিমিটার গ্রুপিং তৈরি করেছিলেন। প্রশিক্ষক ও অন্য প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে অবিশ্বাসের ঢেউ বয়ে গিয়েছিল। সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্তারা সেদিনই বুঝে গিয়েছিলেন, শুটিংয়ের জন্যই জন্মেছেন সন্দীপ সিং। সেই সন্দীপই এখন বরফে আবৃত সিয়াচেনে বলে দেশের প্রতিরক্ষার কাজে ব্যস্ত থাকার ফাঁকে দেখছেন অলিম্পিকের স্বপ্ন। ২৮ বছর বয়সী ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই নায়েব সুবাদারের মনে পড়ছে ইনসাস রাইফেল হাতে নেওয়ার সেই প্রথম দিনটির কথা।

পাঞ্জাবের ফরিদকোটের বেহবল খুর্দ গ্রামে জন্ম সন্দীপ সিংয়ের। বাবা বলজিন্দর সিং একজন শ্রমিক। বাবার সামান্য আয়ে সংসার চালানোই কঠিন ছিল। পরিবারের আয় বাড়ানোর জন্য ছোট বেলায় বাবার সঙ্গে কাজে যেতেন, সাহায্য করতেন নির্মান কার্যে। নির্মাণস্থলে ইট তোলা থেকে শুরু করে রাজমিস্ত্রির কাজ, সবই করেছেন। খেলাধূলা সেই সময় তাঁর কাছে ছিল বিলাসিতা। শ্রমিকের জীবন থেকে পালানোর জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন সন্দীপ। অবশেষে স্বপ্নপূরণ।

সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর উত্তরপ্রদেশের ফতেগড়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে শুরু হয় ট্রেনিং। সেই ক্যাম্পেই প্রথম রাইফেল তুলে নেওয়া। সেদিনও সন্দীপ ভাবেননি, এই রাইফেলই একদিন তাঁর জীবন বদলে দেবে। উত্তরপ্রদেশের ফতেগড়ের এক ধুলোময় মাঠে স্পোর্টস শুটার হিসেবে জীবন শুরু হয়েছিল সন্দীপ সিংয়ের। ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রথম দিনেই লক্ষ্যভেদ দেখে প্রশিক্ষকরা সন্দীপকে বলেছিলেন, ‌তাঁর শুটিং দক্ষতা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। শুট করার জন্য তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন।

সেনাবাহিনীতে যোগদানের পর অ্যাথলেটিক্সের জন্য নিজের আকাঙ্খা নিয়ে স্থির থাকেননি সন্দীপ। পরিবর্তে রাইফেল শুটিংয়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সেনাবাহিনীতে দারুণ স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গেই শুটিং উপভোগ করতে থাকেন। কর্মরত অবস্থাতেই নিজের দক্ষতায় আরও শান দেন। ফলে ২ বছরের মধ্যেই তিনি জাতীয় স্তরে সাফল্য পান। জিতে নেন ব্রোঞ্জ পদক। টোকিও অলিম্পিকে ভারতীয় রিজার্ভ দলেও জায়গা করে নেন।

তবে শুটিং জীবন একেবারেই মসৃন ছিল না সন্দীপের কাছে। বাধা–বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে। ২০২১ টোকিও অলিম্পিকের আগে ডোপ পরীক্ষায় ব্যর্থ হন। ১ বছরের জন্য নির্বাসিতও হতে হয়। যা তাঁর টোকিও অলিম্পিকে খেলার সুযোগ কেড়ে নিয়েছিল। যদিও কোনও নিষিদ্ধ দ্রব্য গ্রহনের কথা অস্বীকার করেছিলেন সন্দীপ। শুধু অলিম্পিকে খেলার সুযোগই হাতছাড়া করেননি, মধ্যপ্রদেশের মাহুতে আর্মি মার্কসম্যানশিপ ইউনিট থেকেও বরখাস্ত করা হয়েছিল সন্দীপকে। তাঁকে আবার সিয়াচেনে ফেরত পাঠানো হয়।

এরপর নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শুরু করেন সন্দীপ। তিনি আবার প্রতিযোগিতামূলক শুটিংয়ে আগ্রহী ছিলেন। নিজের কমান্ডিং অফিসারকে তাঁর স্বপ্নপূরণ করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন সন্দীপ। ঊর্ধ্বতন কর্তার অনুমতি নিয়ে দিল্লি চলে যান। সন্দীপের কথায়, ‘‌সিও স্যার আমার সম্ভাবনার কথা জানতেন। তিনি আমাকে দিল্লিতে ফেরত পাঠান। যেখানে আবার আমি শুটিং শুরু করি। মাহুতে গিয়ে নির্বিঘ্নে শুটিং করেছি। ওএসটি–তে এসে ধারাবাহিকভাবে ৬৩০–৬৪০ এর মধ্যে শট করেছি এবং প্রচুর ম্যাচ সিমুলেশন করেছি।’‌

সিয়াচেনে চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর গতবছর রিও ডি জেনিরোতে বিশ্বকাপ ও এই বছর গ্রানাডায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের মতো আন্তর্জাতিক শুটিং প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। জাকার্তায় এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে যোগ্যতাঅর্জন পর্বে ৬৩৩.‌৪ স্কোর করেছিলেন। যদিও তিনি নবম স্থানে শেষ করেছিলেন।

শিখ লাইট ইনফ্যান্ট্রির সঙ্গে যুক্ত নায়েব সুবেদার সন্দীপের এপ্রিল–মে মাসে দিল্লি এবং ভোপালে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক সিলেকশন ট্রায়ালে স্বপ্নের দৌড় অব্যাহত থাকে। পুরুষদের ১০ মিটার এয়ার রাইফেল ইভেন্টে ট্রায়ালে শীর্ষে ছিলেন। ৬৩৪.‌৪, ৬৩২.‌৬, ৬৩১.‌৬ এবং ৬২৮.‌৩ অলিম্পিকের যোগ্যতাঅর্জন স্কোরসহ তিনটি গড় স্কোরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্কোর করেন।

সন্দীপ অলিম্পিক কোটা বিজয়ী অর্জুন বাবুতা এবং ২০২২ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন রুদ্রাংশ পাটিলকে পরাজিত করেন। বাবুতা দ্বিতীয় ও রুদ্রাংশ তৃতীয় স্থান দখল করেন। শুটিংয়ে দেশের কোটা এবং এনআরএআই–এর নির্বাচন নীতি অনুযায়ী, প্রতিটি ইভেন্টে ট্রায়ালে সেরা দুই ফিনিশার অলিম্পিকে যাবে। সন্দীপ শীর্ষে এবং বাবুতা দ্বিতীয়। এই দুই শুটারই অলিম্পিকে যাচ্ছেন।

প্যারিসগামী ভারতীয়দের অ্যাথলিটদের আনুষ্ঠানিক বিদায়ের ফাঁকে সংবাদমাধ্যমকে সন্দীপ বলেন, ‘‌আমি নির্বাচনের ট্রায়ালের আগে প্রশিক্ষণের সময় নিজেকে বলেছিলাম যে, আমাকে ফোকাসের মাত্রা আরো বাড়াতে হবে এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য ধরে রাখতে হবে। এটাই আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল।’‌ ট্রায়ালে শীর্ষস্থান পাওয়া প্রসঙ্গে সন্দীপ বলেন, ‘‌আমার হারানোর কিছুই ছিল না। আমি শুধু আমার প্রশিক্ষণ কার্যকর করার চেষ্টা করেছি। পাশের লেনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির কথা এক মুহূর্তও ভাবিনি। সুযোগ পেলে একই মানসিকতা নিয়ে প্যারিসে যাব।’‌

২০২১ সালে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সিয়াচেনের হিমাবাহে ৩ মাস কাটানোর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সন্দীপ বলেন, ‘‌কোনও কিছুর সঙ্গে এর তুলনা হয় না। সেখানে শত্রুপক্ষের কোনও অ্যাকশন ছিল না। কিন্তু ৫৪০০ মিটার উচ্চতায় বড় চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে শ্বাস নেওয়া ছিল। ট্রিগারে আঙুল দিয়ে বরফের প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে প্রতিদিন ৬ ঘন্টা পাহারা দিতে হত। সেখানে অক্সিজেন সত্যিই কম। তাই শ্বাস নেওয়া কঠিন কাজ ছিল।  আমি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতাম শ্যুটিং কেরিয়ারের কথা ভেবে। সেই সময় আমি নিজের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করার সময় পেয়েছি, ভবিষ্যতে আমাকে কী করতে হবে এবং কীভাবে আমার শ্যুটিং দক্ষতা উন্নত করতে হবে।’‌

কঠিন দিনগুলিকে পেছনে ফেলে প্যারিস থেকে পদক নিয়ে আসার স্বপ্ন দেখছেন সন্দীপ সিং। তিনি বলেন, ‘‌‌দেশের গৌরব বয়ে আনতে পারাটা হবে সম্মানের। সেনাবাহিনীতে আমাদের এটাই শেখানো হয়। এছাড়া, বাবাকে একটা সুখী অবসর দিতে চাই। অলিম্পিকে ভাল প্রদর্শন আমাকে সেটা করতে সাহায্য করতে পারে।’‌



আরও পড়ুনঃ

অন্যান্য খবর

We are a sports news media company which covers sports across the world. In 2021, "Sports Time" Magazine started its humble journey and quickly won the hearts of sports lover people. After the success of the magazine, we decided to venture into digital pl

Copyright © 2025 Sports Time News Portal . All Rights Reserved. Designed by Avquora